আদর্শ মহীয়সী ::::: এপ্রিল – ’১২

উম্মুল মুমিনীন হাফসা (রা.)

মুফতী আহমাদ ইবনু মুখলিছ

 

পৃথিবীর বুকে  দ্বীন ইসলামকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রাণপ্রিয় স্বামী হারিয়ে যিনি ছোটকালেই বিধবা হয়েছিলেন এবং অধিক ইবাদত-বন্দেগী ও সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে আল্লাহ তা‘আলার এতই প্রিয় হয়েছিলেন যে, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সহধর্মীণী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন, অধিকন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন বিশেষ কারণে তালাক দিয়ে তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার ইচ্ছা করেন, তখন স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা জিবরাঈল (আ.)কে পাঠিয়ে তাকে বিবাহ বন্ধনে রেখে দেয়ার নির্দেশ দেন, তিনি হচ্ছেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সম্মানিতা সহধর্মীণী ও মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর কন্যা হযরত হাফসা (রা.)।

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর স্ত্রী উম্মুল মুমিনীন হযরত হাফসা (রা.)-এর প্রথম বিবাহ হযরত খুনাইস (রা.)-এর সাথে হয়েছিল। তার মাতার নাম ছিল হযরত যাইনাব বিনতে মাইমুনা (রা.) ও তার মামার নাম ছিল হযরত উসমান ইবনু মাযউন (রা.)। হযরত হাফসা (রা.) তার পূর্ব স্বামী খুনাইস (রা.)-এর সাথে মদীনা মুনাওয়ারায় হিজরত করেছিলেন এবং তার স্বামী খুনাইস ইবনু হুজাইফা (রা.) বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন এবং উহুদ যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন।

 

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সান্নিধ্যে আসা

হযরত হাফসা (রা.)-এর ভাই আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রা.) বর্ণনা করেন, আমার ভগ্নিপতি খুনাইস (রা.) যখন উহুদ যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন, তখন আব্বাজান হাফসার বিবাহের ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাই তিনি উসমান ইবনু সাফফান (রা.)কে বললেন, ইচ্ছা করলে আপনি আমার মেয়ে হাফসাকে বিবাহ করতে পারেন। হযরত উসমান (রা.) বললেন, এ ব্যাপারে আমি পরে চিন্তা করে বলব। এর তিন-চার দিন পর হযরত উসমান (রা.) জানালেন যে, আমার আপাতত বিবাহ করার ইচ্ছা নেই।

অতঃপর আব্বাজান হযরত আবু বকর (রা.)-এর নিকট হাফসার বিবাহের প্রস্তাব দেন। কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে হ্যাঁ বা না কিছুই বললেন না। বরং তিনি নীরব থাকলেন।

হযরত উমর (রা.) বলেন, হাফসার বিয়ের প্রস্তাবে উসমানের অসম্মতিতে আমি যতটা না নারাজ হয়েছিলাম, তার চেয়ে বেশী নারাজ হয়েছিলাম আবু বকর-এর নীরব থাকার দ্বারা।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে যখন হাফসার বিয়ে হয়ে যায়, তখন আবু বকর (রা.) হযরত উমর (রা.)-এর সাথে সাক্ষাত করে বললেন, হাফসার বিবাহের প্রস্তাবে আমার নীরব থাকার দ্বারা হয়ত আপনি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন? উমর (রা.) বললেন, অবশ্যই। হযরত আবু বকর (রা.) বললেন, ইতিপূর্বে যেহেতু রাসূলুল্লাহ (সা.) হাফসাকে বিবাহ করার ইচ্ছা করেছিলেন, তাই হাফসার বিয়ের ব্যাপারে আপনার প্রস্তাবে আমি হ্যাঁ বা না কিছুই বলিনি এবং নিজে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ইচ্ছার কথা প্রকাশ করাও সমীচীন মনে করিনি। তাই চুপ ছিলাম। হাফসাকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যদি বিবাহ করার ইচ্ছা না থাকত, তবে আমি তাকে বিবাহ করতাম।

হযরত হাফসা (রা.) কিছুটা তার পিতা হযরত উমর (রা.)-এর মতই নির্ভীক ছিলেন। তাই তিনি নির্দ্ধিধায় রাসূলুল্লাহ (সা.)কে যে কোন প্রশ্ন করতেন। উম্মে মুবাশ্শিরা আনসারী (রা.) বর্ণনা করেন, আমি হযরত হাফসা (রা.)-এর নিকট বসা ছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ইনশাআল্লাহ যারা হুদাইবিয়ার গাছের নীচে বাই‘আত করেছে, তাদের কেউ জাহান্নামে যাবে না। এ কথা শুনে হযরত হাফসা (রা.) সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কিভাবে একথা বলছেন, অথচ আল্লাহ তা‘আলা কালামে পাকে ইরশাদ করেছেন,

“তোমাদের মধ্যে কেউ নেই যে, তার নিকট অর্থাৎ জাহান্নামের নিকট পৌঁছবে না।” (সূরাহ মারয়াম, আয়াত : ৭১) অর্থাৎ আমাদের প্রত্যেকেই তাতে (জাহান্নামে) অবতরণ করবে। এর উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, এরপর তো আল্লাহ তা‘আলা এটাও বলেছেন যে,

“অতঃপর আমি পরহেজগারদেরকে উদ্ধার করব এবং জালিমদেরকে নতজানু অবস্থায় সেখানে ফেলে দিব।” (সূরাহ মারয়াম, আয়াত : ৭২)

আলোচ্য আয়াতে জাহান্নামের উপর স্থাপিত পুলসিরাতের কথা বুঝানো হয়েছে। যার উপর দিয়ে প্রত্যেক ব্যক্তিকেই অতিক্রম করে যেতে হবে। অতঃপর নেককার ব্যক্তিদের আমলের শক্তি অনুযায়ী পুলসিরাতের উপর দিয়ে তাদের চলার গতি নিরূপিত হবে। এভাবে মুমিনগণ পুলসিরাত অতিক্রম করে জান্নাতে যাবেন। পক্ষান্তরে কাফির-মুশরিকরা কেটে কেটে জাহান্নামে পড়ে যাবে। পূর্ণ আয়াতের মর্মার্থ হযরত হাফসা (রা.)-এর স্মরণে ছিল না। তাই তিনি প্রশ্ন করেছিলেন।

হাফসা (রা.) বুদ্ধি-কৌশলে বেশ দক্ষ ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রতিদিন বাদ আসর তাঁর সকল বিবিদের খোঁজ-খবর নিতেন এবং তাদের প্রয়োজনাদির ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। হযরত আয়িশা (রা.) বর্ণনা করেন যে, একবার কোথাও থেকে হযরত যাইনাব (রা.)-এর নিকট মধু হাদিয়া এসেছিল। আর রাসূলুল্লাহ (সা.) মধু খুব ভালোবাসতেন। তাই যাইনাব (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য মধু রেখে দেন। সেই মধু পান করার কারণে অন্যান্য বিবিগণের নিকট যেতে  নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে কিছুটা বিলম্ব হয়ে যায়। এদিকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুহবতের প্রতীক্ষায় হযরত হাফসা ও হযরত আয়িশা (রা.) ব্যাকুল হয়ে উঠেন। সে সময় তারা যখন মধুর বিষয়টি জানতে পারেন, তখন মধু যেন তাদের নিকট অস্থিরতার কারণ হয়ে যায়। কারণ, এই মধুর কারণেই তারা প্রাণপ্রিয় স্বামীর সুহবত থেকে এ সময় বঞ্চিত হয়েছেন। তাই কোন হিংসা-বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে নয়, শুধু তাদের হৃদয়ের পুঞ্জিভূত ব্যথার অভিব্যক্তি প্রকাশ করে হযরত হাফসার সাজেসে তারা মধুকে মাগাফিরের সাথে তুলনা করে এই পরামর্শ করে নিয়েছিলেন যে, তাদের মধ্যে যার গৃহে রাসূলুল্লাহ (সা.) সর্বপ্রথম প্রবেশ করবেন, তিনি বলবেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আপনি কি মাগাফির খেয়েছেন? আপনার পবিত্র জবান থেকে মাগাফিরের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। (মাগাফির হচ্ছে দুর্গন্ধযুক্ত এক প্রকার গাছের কষ। যা পানিতে মিশিয়ে খেতে হয়।)

এ রকম করা হলে, উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমিতো মাগাফির খাইনি। তবে হ্যাঁ, যাইনাবের নিকট মধু পান করেছি। ঠিক আছে, আমি আর তা পান করব না।

রাসূলুল্লাহ (সা.) যেহেতু বিশ্ববাসীর জন্য আদর্শ স্বরূপ, তাই কোন হালাল বস্তুকে নিষিদ্ধ করে নেয়া তার জন্য সমীচীন নয়। সে জন্য আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে আয়াত নাযিল করে রাসূলুল্লাহ (সা.)কে এই কসম ভঙ্গ করার নিদের্শ দেন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

“হে নবী! আল্লাহ আপনার জন্য যা হালাল করেছেন, আপনি আপনার স্ত্রীদের খুশী করতে গিয়ে তা নিজের জন্য হারাম করছেন কেন? আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।” (সূরাহ তাহরীম, আয়াত : ১-২)

এখন প্রশ্ন হলো, সর্বপরি তাদের দ্বারা এই ধরনের ঘটনার অবতারণা কিভাবে হলো? এর জাওয়াব হচ্ছে, উম্মুল মুমিনীনগণ রাসূলুল্লাহ (সা.)কে এতবেশী ভালোবাসতেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুহবত থেকে কোন প্রতিবন্ধকতাই তারা সহ্য করতে পারতেন না। তাই মধুর মত ভালো বস্তুও তাদের নিকট অসহ্য হয়ে গিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুহবতের প্রতি উম্মাহাতুল মুমিনীনগণের কতটা উদগ্র বাসনা ছিল, তার কিছুটা অনুমান এই ঘটনা থেকে পাওয়া যায়।

হযরত হাফসা (রা.)-এর চাতুর্য সম্পর্কে আরেকটি ঘটনা হযরত আয়িশা (রা.) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন সফরে বের হওয়ার ইচ্ছা করতেন, তখন তিনি তাঁর বিবিগণের মনতুষ্টির জন্য তাদের মধ্যে লটারীর ব্যবস্থা করে যার নাম উঠত, তাকে সফরে নিয়ে যেতেন। এমন এক লটারীতে আমার ও হাফসার নাম উঠে। অতএব, আমি ও হাফসা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সফরসঙ্গীণী হই। এই সফরে রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রতিরাতে আমার উটের উপর সওয়ার হতেন। একদিন হাফসা (রা.) বললেন, আপনি আমার উটের উপর সওয়ার হয়ে যান আর আমি আপনার উটের উপর সওয়ার হয়ে যাই। যাতে করে আপনি আমার উটের চরণভঙ্গি দেখতে পান আর আমি আপনার উটের চরণভঙ্গি দেখতে পাই। তখন আমি তার আবদার রক্ষা করে উভয়েই উট বদল করলাম। এদিকে প্রতিদিন যে উটের উপর সওয়ার হতাম, রাসূলুল্লাহ (সা.) সে উটের উপর সওয়ার হয়ে আমাকে পাননি। কারণ, আমি তখন হাফসার উটে একাকি ছিলাম। আর হাফসা তখন আমার উটে ছিলেন। এরই মধ্যে এক মঞ্জিল পথ অতিক্রম হয়ে যায়। হযরত আয়িশা (রা.) বর্ণনা করেন, আমার নিজের ভুলের কারণেই যেহেতু রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুহবত থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম, তাই আমি মঞ্জিলে পৌঁছে উট থেকে নেমে আক্ষেপে পায়ের গোড়ালী ঘাসের সাথে ঘসতে লাগলাম আর নিজে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলাম…। আমার ভুলের কারণেই আমার এত বড় ক্ষতি হয়ে গেল যে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুহবত থেকে বঞ্চিত রইলাম। ….

 

তালাক ও রুজু-এর ঘটনা

রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত হাফসা (রা.)কে তালাকে রজয়ী  (যে তালাকের পর স্ত্রীকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা যায়) দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় দিন হযরত জিবরাঈল (আ.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট আগমন করে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আল্লাহ তা‘আলা হাফসাকে আপনার বিবাহ বন্ধনে রাখার নির্দেশ দিচ্ছেন। কেননা, তিনি যেমন বেশী বেশী নফল রোযা রাখেন, তেমনি রাতে অধিক পরিমাণে নফল নামাযের পাবন্দি করেন। হযরত নাফে (রা.) বর্ণনা করেন,

(এর শুকরিয়া স্বরূপ) হযরত হাফসা (রা.) ইন্তেকালের পূর্ব মূহূর্ত পর্যন্ত অবিরাম রোযার পর রোযা রেখে যাচ্ছিলেন।

 

ইন্তিকাল

হযরত হাফসা (রা.) ৪৫ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন। তাঁর জানাযা হযরত আবু হুরাইরা (রা.) পড়িয়েছিলেন।

Related posts

Leave a Comment